সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূস
বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের NDTV তে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে সেই অস্থিরতা ভারতের সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ-সহ মিয়ানমার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। মূলতঃ তাঁর এই বক্তব্যের পরই সেভেন সিস্টার্স নিয়ে নতুন করে গুঞ্জন শুরু হয়।
সেভেন সিস্টার্স কি?
মোট ২৮টি অঙ্গরাজ্য এবং ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। মানচিত্রের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দেশটির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে বিস্তৃত। চীন, মিয়ানমার, ভুটান ও বাংলাদেশের মধ্যবর্তী ভারতের এই অংশজুড়ে ছড়িয়ে আছে দেশটির ৭টি অঙ্গরাজ্য। অরুনাচল, আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম ও মেঘালয়—এই ৭টি অঙ্গরাজ্যকে একত্রে বলা হয়, সেভেন সিস্টার্স। ভারতের উত্তর-পূর্বের এই অঞ্চলের আয়তন ২ লক্ষ ৬২ হাজার বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা সাড়ে ৪ কোটি। এদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ হিন্দু, ২৫ শতাংশ মুসলিম এবং ১৭ শতাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।
সেভেন সিস্টার্স কেন বলা হয়?
১৯৭২ সালে ত্রিপুরার সাংবাদিক জ্যোতি প্রসাদ সাইকিয়া একটি রেডিও টক-শোতে সর্বপ্রথম উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি অঙ্গরাজ্যকে একত্রে ‘সেভেন সিস্টার্স’ বলে উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে, এই ৭ অঙ্গরাজ্যের ওপর তিনি একটি বই লেখেন, যার নাম দেন ‘ল্যান্ড অফ সেভেন সিস্টার্স’। জ্যোতি প্রসাদ সাইকিয়া-র দেয়া এই নাম ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পায় এবং এর পর থেকে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অঙ্গরাজ্যগুলোর পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকলেও ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে দূরবর্তী হওয়ায় এরা একে অন্যের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। পরস্পরের ওপর এই নির্ভরশীলতা বোঝাতে অঙ্গরাজ্যগুলোকে ‘একই পরিবারের ৭টি বোন’ বললে ভুল বলা হবে না। এ জন্যই এমন নামকরণ।
সেভেন সিস্টার্সের সাথে ভারতের যোগাযোগ
সেভেন সিস্টার্স-এর ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বুঝতে হলে আরেকটি ধারণার সাথে পরিচিত হতে হবে। আর সেটি হচ্ছে ‘চিকেন’স নেক’। মুরগীর দেহের তুলনায় এর গলা খুবই সরু। কিন্তু মুরগীর বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় খাবার ও শ্বাস-প্রশ্বাসের অক্সিজেন সরবরাহের জন্য এই গলাই হচ্ছে একমাত্র পথ। ঠিক একইভাবে ভারতের উত্তর-পূর্বের সেভেন সিস্টার্স ও সিকিম অঙ্গরাজ্যের চিকেন’স নেক হচ্ছে শিলিগুড়ি করিডর। বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যবর্তী ২০ কিলোমিটার প্রস্থের এই করিডর হচ্ছে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে সেভেন সিস্টার্স ও সিকিম অঙ্গরাজ্যে যাওয়ার একমাত্র পথ। সেভেন সিস্টার্স চারদিকে স্থলবেষ্টিত একটি অঞ্চল। নিকটবর্তী সমুদ্র বঙ্গোপসাগরের সাথে এর কোনো সংযোগ নেই। তাছাড়া, এই অঞ্চলের ভূমিও সমতল নয়; বরং দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। ভারতের জন্য সেভেন সিস্টার্স-এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সীমান্তবর্তী প্রতিপক্ষ রাষ্ট্র চীনের অবস্থান এবং সেভেন সিস্টার্স অঙ্গরাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন।
সেভেন সিস্টার্স এ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন
ভারত রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে বিভিন্ন সময় সেভেন সিস্টার্সে সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছে। আসামের ULFA, মণিপুরের UNLF, ত্রিপুরার NLFT, নাগাল্যান্ডের NSCN, মেঘালয়ের HNLC, মিজোরামের MNF, অরুনাচলের NLCT-সহ অসংখ্য সশস্ত্র গোষ্ঠী অঙ্গরাজ্যগুলোতে নিজেদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘাত চালিয়ে যাচ্ছে। এসব বিদ্রোহের প্রধান কারণ- ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার সময় ওই অঞ্চলের মানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলন না হওয়া, মূল ভূখণ্ডের তুলনায় এ অঞ্চলে উন্নয়নের বৈষম্য এবং সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলের আদিবাসীদের জাতিগত ভিন্নতা।
বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার সাথে সেভেন সিস্টার্সের কী সম্পর্ক?
সেভেন সিস্টার্সের ৭টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৪টির সাথেই বাংলাদেশের সরাসরি সীমানা রয়েছে। তাছাড়া, অপর ৩টি অঙ্গরাজ্যও এ দেশের খুব নিকটবর্তী। ভারত সরকারের সাথে বিবাদমান সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সীমান্ত এলাকা ব্যবহার করে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ (বিজিবি)-এর সচেষ্টতায় গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারছে না বলে জানিয়েছে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী- বিএসএফ। সেভেন সিস্টার্সে ভারতের যোগাযোগ বাড়াতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কয়েকটি কৌশলগত অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। আন্তঃসীমান্ত রেলপথের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা তথা সেভেন সিস্টার্সকে সংযুক্ত করা হবে। একই সাথে, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে সেভেন সিস্টার্সে পণ্য পরিবহনেরও পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের সাবেক সরকারের আমলে। তবে ভারতের জন্য আশংকার বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে দেশটির দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। গত কয়েক বছরে নেপাল ও মালদ্বীপ ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বেড়িয়ে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বাংলাদেশের সরকার বদলের ফলে সেভেন সিস্টার্স-এর সাথে আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ প্রকল্পগুলো নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তায় পড়েছে ভারত। এ পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশে বহির্বিশ্বের ইন্ধনে কোনো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে, সেই সুযোগ নেবে সেভেন সিস্টার্সের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো। ফলে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে, ভারতের স্থিতিশীলতাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।